প্রবোধিনী একাদশী: দেবোত্থান ও মহাপুণ্যের এক মহিমান্বিত তিথি

Temple Organization মন্দির সংস্থা
0

🌟 প্রবোধিনী একাদশী: দেবোত্থান ও মহাপুণ্যের এক মহিমান্বিত তিথি 🌟

হিন্দু ধর্মানুসারে, প্রবোধিনী একাদশী একটি অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ তিথি, যা প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীতে পালিত হয়। এই দিনটি চাতুর্মাস্য ব্রতের সমাপ্তি সূচিত করে এবং বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়, যার ফলে এই একাদশী 'দেবোত্থান একাদশী' বা 'বিষ্ণু জাগরণ একাদশী' নামেও পরিচিত। পৌরাণিক মতে, ভগবান বিষ্ণু আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী (শয়ন একাদশী) থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী পর্যন্ত চার মাস যোগনিদ্রায় থাকেন। এই চার মাসকে চাতুর্মাস্য বলা হয় এবং এই সময়ে সকল শুভ কাজ যেমন বিবাহ, উপনয়ন ইত্যাদি স্থগিত থাকে। প্রবোধিনী একাদশী সেই নিদ্রাভঙ্গের দিন, যখন দেবতারা পুনরায় জাগ্রত হন এবং পৃথিবীজুড়ে শুভশক্তির প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

📖 একাদশীর মহিমা ও তাৎপর্য

শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুসারে, প্রবোধিনী একাদশী কেবল একটি উপবাসের দিন নয়, এটি আত্মার জাগরণ, পবিত্রতা অর্জন এবং পারমার্থিক উন্নতির এক সুবর্ণ সুযোগ। এই দিনে ব্রত পালন করলে অজান্তেও করা সমস্ত পাপের মোচন হয় এবং ভগবান বিষ্ণুর অসীম কৃপা লাভ হয়। কথিত আছে, এই একাদশী ব্রতের ফল সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত বাজপেয় যজ্ঞের ফলের সমান।

বিভিন্ন পুরাণে এই একাদশীর মাহাত্ম্য বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ এবং শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ-এ এই পবিত্র তিথির উল্লেখ পাওয়া যায়। পদ্ম পুরাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে এই ব্রতের মহিমা বর্ণনা করে বলেন যে, “প্রবোধিনী একাদশীতে উপবাস করে যে ব্যক্তি ভগবান বিষ্ণুর পূজা করেন, তার পূর্বপুরুষরা নরক থেকে উদ্ধার পেয়ে বৈকুণ্ঠ লাভ করেন।”

এই দিনেই তুলসী বিবাহের আয়োজন করা হয়। তুলসীকে দেবী লক্ষ্মীর রূপ মনে করা হয় এবং শালগ্রাম শিলা (বিষ্ণুর প্রতীক) বা কৃষ্ণের সাথে তাঁর বিবাহ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ভক্তরা গৃহস্থ জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন এবং শ্রীবিষ্ণুর আশীর্বাদ লাভ করেন।

🙏 ব্রত পালনের বিস্তারিত পদ্ধতি

প্রবোধিনী একাদশী ব্রত পালনের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ও আচার রয়েছে যা ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করা উচিত:

  • ১. দশমীর দিন প্রস্তুতি: একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমীর দিন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। এই দিনে একবার আহার গ্রহণ করতে হয় এবং ব্রহ্মচর্য পালন করা আবশ্যক। আমিষ খাদ্য, পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য তামসিক দ্রব্য পরিহার করতে হয়।
  • ২. প্রাতঃকালে স্নান ও শুদ্ধি: একাদশীর দিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে (ভোরবেলায়) ঘুম থেকে উঠে পবিত্র নদীতে বা বাড়িতেই গঙ্গা জল মিশ্রিত জলে স্নান করতে হয়। স্নানের পর পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করে মনকে শান্ত ও পবিত্র করতে হয়।
  • ৩. সংকল্প গ্রহণ: পূজার শুরুতে ব্রত পালনের সংকল্প নিতে হয়। হাত জোড় করে ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে ব্রত পালনের উদ্দেশ্য ও নিয়মাবলী মনে মনে প্রার্থনা করতে হয়।
  • ৪. বিষ্ণু পূজা: এই দিনে শ্রীবিষ্ণুর বিশেষ পূজা করা হয়। তাঁর শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করা রূপের পূজা করা হয়। মূর্তি বা ছবির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপ জ্বেলে, চন্দন, ফুল (বিশেষ করে তুলসী পাতা ও মঞ্জরী), ফল, মিষ্টি এবং তুলসী জল নিবেদন করা হয়। তুলসীকে এই দিনে বিশেষ ভাবে সম্মান জানানো হয়, কারণ তুলসী বিষ্ণুপ্রিয়া।
  • ৫. উপবাস: সম্পূর্ণ উপবাস রাখা উত্তম। যারা সম্পূর্ণ উপবাসে অক্ষম, তারা ফলাহার, দুগ্ধজাত দ্রব্য (দুধ, দই), বাদাম বা নির্দিষ্ট কিছু সবজি (যেমন আলু, কাঁচা কলা) গ্রহণ করতে পারেন। তবে শস্য, ডাল, লবণ, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আমিষ খাদ্য ইত্যাদি কঠোরভাবে বর্জনীয়। শুধুমাত্র একবার জল পান করাকে নিরব উপবাস বলা হয়।
  • ৬. জপ-তপ ও ভজন: দিনের বেলায় এবং রাতে জাগরণ করে ভগবান বিষ্ণুর নাম জপ করা অত্যন্ত ফলদায়ক। "ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়" মন্ত্রটি প্রধান। এছাড়া, "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে" এই মহামন্ত্র জপ করা যেতে পারে। বিষ্ণু সহস্রনাম পাঠ, গায়ত্রী মন্ত্র জপ এবং শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ করলে আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
  • ৭. রাত জাগরণ (জাগরণ): প্রবোধিনী একাদশীর রাতে জাগরণ করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। এই রাতে ভগবানের নাম সংকীর্তন, ভজন, কৃষ্ণ কথা শ্রবণ এবং তাঁর লীলা স্মরণ করে কাটানো হয়। এটি মনকে জাগতিক ভোগ থেকে দূরে রেখে আত্মিক চেতনায় উন্নীত করে।
  • ৮. দান-পুণ্য: এই দিনে দান-পুণ্যের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। দুঃস্থ ও দরিদ্রদের অন্ন, বস্ত্র, ফল অথবা অর্থ দান করলে ভগবান অত্যন্ত প্রসন্ন হন। মন্দির বা ধর্মীয় কাজেও দান করা যেতে পারে। তুলসী গাছ রোপণ করা বা তুলসী দান করাও শুভ বলে মনে করা হয়।
  • ৯. পারণ: একাদশীর পরদিন অর্থাৎ দ্বাদশীর সকালে (সূর্যোদয়ের পর) পারণ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত সকাল ৬টা থেকে ১০টার মধ্যে) উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। পারণ করার আগে ভগবান বিষ্ণুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল কামনা করতে হয়। পারণ হিসেবে সাধারণত ফল, মিষ্টান্ন বা সাধারণ সাত্ত্বিক খাবার গ্রহণ করা হয়। শস্য গ্রহণ করে পারণ করা হয়।

পারণের মন্ত্র: "হে পুণ্ডরীকাক্ষ, হে সর্বজ্ঞ জনার্দন, এই ব্রত পালন করে আমার সমস্ত পাপ মোচন হোক। হে মাধব, তুমি আমার এই ব্রত সফল কর।"

🌟 আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ফল

প্রবোধিনী একাদশী ব্রত পালনের ফলে শুধুমাত্র পারলৌকিক কল্যাণই হয় না, জাগতিক জীবনেও এর সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।

  • 💖 মানসিক শান্তি ও স্থিরতা: নিয়মিত ব্রত পালনের মাধ্যমে মন শান্ত হয়, ক্রোধ ও অস্থিরতা কমে আসে।
  • 💖 শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধি: উপবাসের ফলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়, যা শরীরকে সুস্থ রাখে। ইন্দ্রিয় সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • 💖 পাপ মোচন: এই ব্রত সকল প্রকার পাপের মোচন ঘটায় এবং ব্যক্তিকে পবিত্র জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে।
  • 💖 পরিবারের কল্যাণ: এই ব্রত পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সুখ, সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু বয়ে আনে।
  • 💖 আধ্যাত্মিক জাগরণ: এটি আত্মাকে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।
  • 💖 সামাজিক সম্প্রীতি: দান-পুণ্য ও সেবামূলক কাজের মাধ্যমে সমাজে সহানুভূতি ও নৈতিকতা বৃদ্ধি পায়, যা শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।

প্রবোধিনী একাদশীর এই মহিমান্বিত তিথিটি কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানব জীবনে এক নতুন শুভ সূচনা, যেখানে আধ্যাত্মিক চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধের পুনরুত্থান ঘটে।

“এই একাদশী মনুষ্য জীবনের অন্ধকার দূর করে এবং আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটায়।”

🕉 মন্ত্র ও প্রার্থনা

  • প্রধান মন্ত্র: “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” (এটি বিষ্ণুর দশাক্ষর মন্ত্র এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী)
  • মহামন্ত্র: “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”
  • বিষ্ণু সহস্রনাম: ভগবান বিষ্ণুর সহস্র নামের স্তোত্র পাঠ করলে সকল প্রকার মঙ্গল হয়।
  • বিষ্ণু জাগরণ মন্ত্র: “উত্তিষ্ঠোত্তিষ্ঠ গোবিন্দ ত্যজ নিদ্রাং জগৎপতে। ত্বয়ি সুপ্তে জগৎ সুপ্তং জাগ্রতে জাগ্রতং পুনঃ।” (অর্থাৎ: হে গোবিন্দ, হে জগৎপতি, উঠুন, জাগুন, আপনার নিদ্রা ত্যাগ করুন। আপনি নিদ্রিত থাকলে জগতও নিদ্রিত থাকে, আর আপনি জাগ্রত হলে জগতও জাগ্রত হয়।)

বিষ্ণু দেবের একটি চিত্র:

🍃 খাদ্য নিয়মাবলী (বিশদ)

একাদশীর দিন ভোজনের ক্ষেত্রে বিশেষ সংযম পালন করা হয়। এই নিয়মগুলি ধর্মীয় এবং স্বাস্থ্যগত উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

  • খাওয়া যায়:
    • ফল: সকল প্রকার ফল (যেমন আপেল, কলা, আঙুর, কমলা, বেদানা ইত্যাদি)।
    • দুগ্ধজাত দ্রব্য: দুধ, দই, ছানা, পনির (লবণ ছাড়া)।
    • সবজি: আলু, কাঁচা কলা, মিষ্টি আলু, লাউ, কুমড়ো, টমেটো, শসা, আদা, লেবু, ধনে পাতা। তবে মাটির নিচে জন্মানো সবজি (যেমন গাজর, মূলা) কিছু ক্ষেত্রে বর্জনীয়, যদিও বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এর ভিন্নতা দেখা যায়।
    • বাদাম ও শুকনো ফল: চিনাবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তা, কিশমিশ, খেজুর।
    • শস্য বিকল্প: কিছু ক্ষেত্রে সাবু, শিংড়া আটা (জল ফলের আটা), কুট্টু আটা (বকবলের আটা) ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে শস্য সম্পূর্ণরূপে বর্জন করাই উত্তম।
    • মশলা: জিরা, কালো গোলমরিচ, আদা, এলাচ, দারচিনি। লবণ হিসেবে শুধুমাত্র সৈন্ধব লবণ (rock salt) ব্যবহার করা হয়।
  • খাওয়া যাবে না:
    • শস্য ও ডাল: চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, যব, ছোলা, মুগ, মসুর ইত্যাদি সকল প্রকার শস্য ও ডাল কঠোরভাবে বর্জনীয়।
    • আমিষ খাদ্য: মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন।
    • নিষিদ্ধ সবজি: বেগুন, কপি, মূলা (কিছু মতে)।
    • নিষিদ্ধ মশলা: হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, হিং, জিরা গুঁড়ো (অন্যান্য মশলার সাথে মেশানো)। সাধারণ লবণ ব্যবহার করা যাবে না।
    • অন্যান্য: মদ, তামাক, চা, কফি, নেশাজাতীয় দ্রব্য।

🌟 উপসংহার

প্রবোধিনী একাদশী কেবল একটি ব্রত নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং ভগবানের সাথে সংযোগ স্থাপনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। এই পবিত্র দিনে উপবাস, ভজন, পূজা এবং দান-পুণ্যের মাধ্যমে ভক্তরা নিজেদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করেন এবং পরমাত্মার কৃপা লাভ করেন। শ্রীবিষ্ণুর জাগরণের এই উৎসব আমাদের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক জ্যোতি নিয়ে আসুক, এই প্রার্থনা করি।

“এই একাদশী পালনে অসংখ্য জন্মের পাপ নাশ হয় এবং ঈশ্বরকৃপা লাভ হয়।”

বিষ্ণুর জাগরণ উৎসব পালনের মাধ্যমে জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

✍ লেখক: Ranjit Barmon

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
3/related/default